নো-ম্যান্স ল্যান্ড (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-১)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৯ মার্চ, ২০১৫, ০২:০৬:০৩ দুপুর
বর্ডার সংলগ্ন একটি স্কুল ও কলেজের নির্জন এক কক্ষে একজন যুবক অধ্যক্ষ নিজের ভাবনাতে ডুবে ছিল। ‘এল’ শেপের বিল্ডিঙ্গটির সামনে সুদৃশ্য বিশাল এক মাঠ। এরপরেই তিনদিকে কবর নিয়ে কাকচক্ষু জলের গভীর এক দীঘি। আশপাশের চার গ্রামের এই একটি ই স্কুল ও কলেজ। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত দীঘির পাড়! গ্রামের মানুষদের শেষ বিশ্রামের জন্য খুব সুন্দর জায়গাই বটে।
দীঘির পাড় বেশ উঁচু। চাঁদের মায়াবী আলোয় নতুন-পুরাতন কবরগুলো কেমন ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। নতুন কারো জন্য এরকম বিশাল এক বাউন্ডারী বিহীন যায়গায় ভয় পাবারই কথা। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের নতুন অধ্যক্ষ অন্য ধাতুতে গড়া। হৃদয়ের কানায় কানায় ভালোবাসায় পূর্ণ আটাশ বছরের এই যুবকের ভয় পাবার মতো একটুও জায়গা খালি নেই। গ্রামের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পদে গত ছ’মাস আগে বুকে এক নব-উদ্যম নিয়ে এখানে যোগ দিয়েছিল। এই মাসগুলোতে সে অনেক কিছু দেখেছে-বুঝেছে।
কিন্তু উপলব্ধি করেছে কতটুকু?
স্টীলের একটি ফোল্ডিং খাটে আধশোয়া হয়ে আছে সে। সাথে একটি ছোট্ট টেবিল এবং চেয়ার। এই তিনটি জিনিসই এই রুমের আসবাবপত্র। টেবিলের সাথেই মেঝেতে আরাম করে বসে আছে এই রুমের দ্বিতীয় প্রাণি।
প্রাণি বলাটা কি ঠিক হল?
ষাট ছুঁই ছুঁই এক বৃদ্ধ। এই প্রতিষ্ঠানের দপ্তরী কাম নাইটগার্ড। কানে একটু কম শোনে। এই বয়সে চোখে যতটুকু দেখবার কথা তাঁর থেকে বেশীই দেখে। একটু অতিরিক্ত বেশী না?
ভাবে রায়হান।
এখানে জয়েন করার পর বৃদ্ধকে একটি ‘হেয়ার এইড’ কিনে দেবার পর আজকাল সে কানেও একটু বেশী শোনা শুরু করেছে! যা শোনার প্রয়োজন নেই তা ও শোনে। আর এই বেশী শুনে ফেলার জন্য তাঁর পেটটি ফুলে যায়। তৃতীয় কাউকে না বলা পর্যন্ত চৌধুরীর শান্তি হয় না।
হ্যা, এই বৃদ্ধটির নাম আলতাফ চৌধুরী। তবে এখন সে সবার কাছে চৌধুরী। অনেকে নামটিকে বিকৃত করে ডাকে ‘চোধরী’। তবে তাতে চৌধুরীর কিছুই যায় আসে না। সে ওর এই নতুন ‘স্যারের’ খুবই বিশ্বস্ত। এই মানুষটিকে সে খুব ভালোবাসে। সম্মান করলে সেটি ‘শুধুই সম্মান’ করা হয়। সেখানে যদি ভালোবাসা না থাকে, তবে সেই সম্মানের মানে লোক দেখানো একটি ভন্ডামি। আগে প্রয়োজন ভালোবাসা। একে ঘিরে ধীরে ধীরে সব কিছু কেন্দ্রীভূত হয়।
বৈশাখের রাত!
আজ পূর্ণিমা। এই প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। জেলা শহরের দিকে চলে যাওয়া রাস্তার ওপারে পল্লী বিদ্যুৎ রয়েছে। গ্রামগুলো আলোকিত; কিন্তু এগুলোকে আলোকিত করার এই প্রতিষ্ঠান যেখান থেকে নিয়ত আলোকিত মানুষ তৈরী হচ্ছে – সেটি জমাট অন্ধকারে ডুবে আছে। গত পঞ্চাশ বছর ধরে এভাবেই রয়েছে।
ঈশ্বর নিজেই আলো।
আজ বোধহয় তিনি নিজের থেকে একটি অতিরিক্ত আলো ধার দিয়েছেন। এই ভরা পূর্ণিমায় রূপালী স্রোতে পুরো এলাকাটি ভেসে যাচ্ছে! জানালা এবং দরোজা খোলা। রাত দশটা পার হয়েছে অনেক আগে। গ্রামের জন্য এখন বলতে গেলে মধ্যরাত। অনেকের ইতোমধ্যে একঘুম দেয়া হয়ে গেছে।। দক্ষিণ দিক থেকে জলে ভেজা মৃদুমন্দ বাতাস দীঘির বুকের দীর্ঘশ্বাসগুলোকে ধারণ করছে। এরপর মাঠের সুন্দর করে ছাটা সবুজ ঘাসকন্যাদের হৃদয়ের অবদমিত কান্নাকে সাথে করে নিয়ে অর্ধ-শতাব্দী প্রাচীন এই ভবনটির পুরনো একটি কক্ষে ভাবনার জগতে থাকা একজন মেকুরের হৃদয়ে থেকে থেকে বেদনাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। তবে এমনই সেই লিলুয়া বাতাস- একই সাথে ভালোলাগার অন্য এক আবহেও হৃদয়কে তোলপাড় করতে জানে।
এবং এই মুহুর্তে খোলা দরোজা-জানালা দিয়ে সে সেই কাজটি খুব নিপুণভাবে করে চলেছে!
হ্যারিকেনের মৃদু ঘোলাটে আলোয় চৌধুরীর ছানিকাটা চোখ আরো ঘোলাটে লাগে। কেমন যেন ‘মানুষের দৃষ্টি’ মনে হয় রায়হানের কাছে। ওর আশেপাশে ‘পশুর দৃষ্টি’ নিয়ে কিছু ‘পশুমানবদের’ চোখের হিংস্র দৃষ্টি দেখে দেখে এরকম ‘মানব দৃষ্টি’ গত ছয় মাসে খুব কমই দেখতে পেয়েছে সে।
মায়ের কথা মনে পড়ল।
এরপর দুই বেনীওয়ালা একজনের।
নাকি আগে দুই বেনীওয়ালা একজনকে... এরপর মা কে?
গত পনের দিন ধরে নিজের ভেতর নিরবচ্ছিন্ন এরকম কিছু ‘কনফিউজড যন্ত্রণায়’ থেকে থেকে নীল হয়ে চলেছে রায়হান। এ এমনই এক যন্ত্রণা যা দ্বিতীয় কাউকে বলা তো দূরে থাকুক, খোদ নিজেকেই শেয়ার করতে ইচ্ছে করে না।
পনের দিন আগেও মা ই ছিল ওর জগত।
এখন কি নেই?
কণার সাথে আকদের পর থেকেই মা কি জগতের দূরতম তারায় পরিণত হলেন? জগতের ওপারে চলে গেলেন মিটিমিটি আলো হয়ে?
না কি মা নিজেই একটি আলাদা জগতে পরিণত হলেন বিচ্ছিন্নভাবে?
এরকম কয়টি জগত থাকে মানুষের?
রায়হান কয়টি অনুভব করছে?
অস্ফুটে কিছু একটা বলে উঠে রায়হান। চিন্তার যন্ত্রণাকর বাঁধন আলগা করতেই কি এই শব্দ করা? নিজেকে জানান দেয়া যে কোথায় রয়েছি?
প্রভুভক্ত কুকুরের মতো নিজের কান খাড়া করে চৌধুরী ওর ‘স্যারের’ দিকে তাকায়।
ইশারায় রায়হান ওকে টেবিলের উপর থেকে কিছু একটা দিতে বলে। ছোট্ট একটা অ্যালুমিনিয়ামের বালতির ভিতর থেকে বিয়ারের একটা ভেজা ক্যান চৌধুরী বের করে রায়হানকে দেয়। পরক্ষণেই মেঝেতে আগের যায়গায় বসে নিজের জরাজীর্ণ ঘোলাটে চিন্তার জগতে নিশ্চুপ হয়ে যায়।
এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন প্রতিষ্ঠান প্রধানের হাতে বিয়ারের ক্যান শোভা পাচ্ছে! একটু অবাক হবার মতো ব্যাপার হলেও এ তো কিছু ই না। গত ছ’মাসে একজন প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে ‘শিক্ষা’ শব্দটির সাথে সংশ্লিষ্ট সকল ইউনিটগুলোতে এমন সব অবাক করা কর্মকান্ড সে নিজে দেখেছে- এখনো দেখছে , তার তুলনায় বিয়ারের ক্যান হাতে একজন অধ্যক্ষের ‘নৈশজীবন’ তো কিছুই না। ইউনিয়ন-থানা-জেলা থেকে শুরু করে সেই খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ ইউনিটের প্রধানের কক্ষ পর্যন্ত- সবই একই রকম। অবাক হবার মতো অনেক ব্যাপার স্যাপার রয়েছে।
এসব দেখে দেখে তেঁতো মনটাকে বিয়ারের তিক্ত স্বাদে আরো কিছুটা কটু না করা পর্যন্ত কেন জানি শান্তি পায়না সে আজকাল।
আর সেই শান্ত মুহুর্তটিতে ইদানিং মা এবং কণা সামনে এসে দীঘির জলে চাড়া (মাটির বাসনের ভাঙা মসৃণ টুকরা) নিক্ষেপের ফলে ধাপে ধাপে সম্মুখগতি লাভের বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় পানির বিক্ষেপনের মতই শান্ত জলকে অস্বস্তিকর অশান্ত করার অনুভূতি এনে দেয়।
আর তখনই একজন মেকুর জীবনকে জীবনের ভেতর থেকেই অনুভব করতে চায়। ব্যর্থ হয়ে জীবনে বাইরে থেকে দেখবার চেষ্টা করে। সেখান থেকে নিজেকে বড়ই রিক্ত, নিঃস্ব এবং অসহায় দেখতে পায়। মুহুর্তে আবার ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু কেন জানি সেই মুহুর্তে সহজে ভেতরেও প্রবেশ করতে পারে না।
জীবনের ভেতর বাহির করা এমন কষ্টকর কেন?
ফিরে আসতেও অপেক্ষার গ্লানিকর মুহুর্তগুলোর সাথে সাক্ষাৎ ঘটে কেন?
বর্ডার সংলগ্ন এক নির্জন এলাকায় একজন রাউহানের মনে হয় কাছের মানূষদেরকে নিকটবর্তী শহরে রেখে সে নিজে এক নো-ম্যান্স ল্যাণ্ডে অবস্থান করছে। এমন এক নির্জনতার মাঝে সে ডুবে আছে কি ভেসে আছে- ঠিক বুঝতে পারে না।
কিন্তু সে যে আছে সেটি অনুভব করে বিয়ারের ক্যান থেকে শীতল ঝাজালো তিক্ত স্বাদের তরলটুকু হৃদয়কে ক্রমেই উষ্ণ থেকে উষ্ণতর করে তোলাতে। অথচ একটু শীতল হতেই না একে গ্রহন করা। বুকটা জুরিয়ে যাবে ভেবেই না তরল-গরলকে পান করা!
বারান্দার প্রাচীন পিলারের সাথে ক্যানটির ‘ঠং’ শব্দে চৌধুরী ঘোলাটে চোখে তাকায়। নিঃ শব্দে উঠে গিয়ে ক্যানটি তুলে নিয়ে নিজের হেফাজতে রাখে। ওর ‘স্যারের’ সবকিছুই সে নিরাপদে রাখছে আজকাল। এই প্রতিষ্ঠানটির সাথে সে এই প্রতিষ্ঠান প্রধানের ও কেয়ারটেকার।
দরোজাটি চাপিয়ে দিয়ে নিজের অবস্থানের দিকে যেতে উদ্যত হয় চৌধুরী। চলার পথা খোলা জানালা দিয়ে ঘোলা চোখে ওর ‘স্যারকে’ একবার দেখার চেষ্টা করে। বেশ স্পষ্ট দেখতে পায়। এই মুহুর্তে মায়া মেশানো রয়েছে চৌধুরীর চোখে!
রাতের বাতাসকে আরো মাতাল করে তোলে মিতা হকের কন্ঠে ‘রোদন ভরা এ বসন্ত’ রবীন্দ্র সংগীতের সুরেলা শাব্দিক অনুরণন। সাদা শুশ্রুমন্ডলিতে ঢাকা ঠোঁটের দু’পাশে মৃদু হাসি নিয়ে চৌধুরী হেঁটে চলে লম্বা এল শেপ বিল্ডিঙ্গটির প্রশস্ত বারান্দা ধরে।
সময় তখন মধ্যরাত।
একজন মেকুর নো-ম্যান্স ল্যান্ডে এখন সত্যি ই একা!
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
৮৯৩ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন